জনগণের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়...
July 26, 2024
বাংলাদেশে প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রীদের শোনা যায় "সরকারি টাকায়" এটা করা হচ্ছে, ওটা করা হচ্ছে। আসলেই কি ব্যাপারটা এরকম?
সরকারের টাকার উৎস কী
দেশ চালাতে সরকারের টাকা লাগে, যেমন: রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, সরকারী কর্মচারীদের বেতন ও পেনশন দেয়া।
সরকারের কোন উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা, ব্যবসা বা কৃষিকাজ নেই, তাহলে সরকার কিভাবে খরচ করার মত টাকা পায়?
সরকার ইচ্ছা করলেই টাকা প্রিন্ট করে ব্যবহার করতে পারে না, কারন এতে টাকার মূল্য হারায়।
সরকার কিভাবে টাকা পায় তা বুঝার সহজ উপায় হচ্ছে বার্ষিক বাজেটে টাকার উৎস দেখা।
বাজেটে টাকার উৎস
সূত্র: অর্থ মন্ত্রনালয় ওয়েবসাইট
প্রথমে টাকার উৎসের খাত গুলো সংক্ষেপে ব্যাখা করা যাক:
- জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর: গাড়ি, জমি-উন্নয়ন, মদ ইত্যাদির কর
- জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর: আয়কর, ভ্যাট, আমদানী-রপ্তানী কর
- কর ব্যতিত প্রাপ্তি: বিভিন্ন সরকারি ফি, টোল আদায়, সুদ ইত্যাদি
- বৈদেশিক ঋণ: বিদেশী সংস্থা থেকে প্রাপ্ত ঋণ, যা অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়, সুতরাং এটা প্রকৃতপক্ষে আয় নয়।
- অভ্যন্তরীণ ঋণ: জনগনের সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে জমা রাখা টাকা থেকে নেয়া ঋণ। এটাও পরিশোধ করতে হয়।
- বৈদেশিক অনুদান: এটি খুবই সামান্য (০.৫%)। এটাকে হিসাবে না ধরলেও চলে।
এখানে মূল আয় হচ্ছে রাজস্ব বা কর (৬২.১%) যা পুরপুরি জনগণের থেকে আসে এবং কর ব্যতিত প্রাপ্তি (৫.৮%), এটাও জনগণের টাকা থেকেই আসে।
বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ (মোট ৩১.৬%) বাজেটে কাজে লাগানো হলেও এই ঋণ আলটিমেটলি পরিশোধ করতে হয় আগের দুটি খাত থেকেই, কারন সরকারের অন্য
কোন ভাবে টাকা পাওয়ার উপায় নেই।
তার মানে, ০.৫% ব্যতিত সরকারের খরচের পুরো টাকাই আসে জনগনের টাকা থেকে।
দেশ চলে কার টাকায়
যেহেতু সরকার তার খরচের সব টাকায় পায় জনগন থেকে, সুতরং দেশ চলে জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়।
- রাস্তাঘাট, ফ্লাই ওভার তৈরি হয় জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
- মেট্রোরেল তৈরি হয় জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
- পদ্মাসেতু তৈরি হয় জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
- বিদ্যু সরবরাহ হয় জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
- সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
- সরকারি চাকরীজীবিদের বেতন দেয়া হয় জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
- সরকারি অফিস, কর্মকর্তাদের চেয়ার-টেবিল তৈরি হয় জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
- এমপি মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি চলে জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
- সরকারি কর্মকর্তা ও এমপি মন্ত্রীরা বিদেশ ভ্রমণ করে জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়
সরকারের টাকায়
যেহেতু সবকিছুই জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকা থেকে আসে তাহলে প্রধানমন্ত্রী কেন বারবার "জনগনের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায়" না বলে "সরকারী টাকায়" বলে?
উত্তরটি খুবই সহজ।
প্রথমত, আমরা যে সরকারকে টাকা দিচ্ছি তা বুঝতে পারি না।
- ঢাকা ব্যতিত বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ আয়কর বা ইনকাম ট্যাক্স দেয় না।
- গ্রামের অধিবাসী বা স্বল্পআয়ের মানুষেরা জানে না যে মধ্যম-উচ্চ আয়ের মানুষেরা প্রতি মাসে সরকারকে কত টাকা আয় কর দিচ্ছে।
- গ্রামের অধিবাসী বা স্বল্পআয়ের মানুষ এবং যারা কখনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে নি তারা জানে না যে, কোম্পানিগুলো সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স দেয় প্রতি মাসে এবং বছরে।
- বাংলাদেশের প্রায় ৭০% জনগন গ্রামে বাস করে, তাই সরকারকে যে অনেকে সরাসরি ট্যাক্স দিচ্ছে, তা দেশের বেশিরভাগ মানুষই জানে না বা এটা উপলব্ধি করতে পারে না।
- দেশের সবাই মূলত ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর দেয়, যেমন: মোবাইল ফোন রিচার্জ, বাজার থেকে মোড়কজাত কিছু কেনা, ইলেট্রনিক্স যন্ত্রপাতি কেনা, শো-রুম থেকে জামাকাপড় কেনা ইত্যাদি। আপনি কি জানেন, ২০২৮-২০২৫ বাজেট অনুসারে আপনি মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে, তা থেকে সরকার পায় ৩৯ টাকা? যেহেতু এই টাকা সরাসরি সরকারের হাতে দেয়া হয় না তাই বেশিরভাগ জনগন বুঝতে পারে না যে সরকারকে টাকা দেয়া হচ্ছে। বছর শেষে এভাবেই যে সরকারকে ১,৮২,৮৮০ কোটি টাকা দেয়া হয়ে যায়, এটা আমরা বুঝতে পারি না।
দ্বিতীয়ত, গ্রামে বসবাসকারী স্বল্প-শিক্ষিতদের অনেকেই মনে করেন, শেখের বেটি বিদেশীদের কাছ থেকে সাহায্য এনে দেশের মানুষকে খাওয়ান।
হাস্যকর এবং দুঃখজনক হলেও ব্যাপারটি সত্য।
সরকার/প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারগুলোরই সুযোগ নেয়। কারন এতে জনগনের উপর প্রভাব খাটাতে সুবিধা হয়। সব জনগন যদি জেনে যায়, যে তাদের টাকায় দেশ চলে, তবে
এই টাকার অপব্যবহার করলেই জনগন কৈফিয়ত চাবে।
দুর্নীতিতে সুবিধা
শুধুমাত্র ভ্যাট থেকে ১,৮২,৮৮০ কোটি টাকা ধরলে, ১৮ কোটি জনগনে, আমরা বছরে জনপ্রতি ভ্যাট দেই ১০,১৬০ টাকা করে।
যদি শুধু ১৫ বা তার অধিক বয়সীদের (৭১.৩৯%, আদমশুমারী ২০২২) ধরা হয় তবে জনপ্রতি হয় ১,৮২,৮৮০/(১৮*০.৭১৩৯) = ১৪,২৩১ টাকা। আমরা যদি
জানি যে, আমাদের সবার কাছ থেকে বছরে ১৪,২৩১ টাকা চাঁদা নিয়ে তারা দুর্নীতি করছে, অ্যামেরিকা-কানাডা-লন্ডনে টাকা পাচার করে বাড়ি কিনছে, আমাদের টাকা পাচার
করে তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াশুনা করাচ্ছে, আবার আন্দোলন করলে আমাদেরকেই গুলি করছে, জেলে ভরছে, তাহলে আমাদের কেমন লাগবে?
"সরকারের টাকায়" সবকিছু হয় - এভাবে বললে, এবং কমপক্ষে ৭০-৮০% জনগনকে তা বিশ্বাস করাতে পারলে তাদের এই সমস্যাটা তৈরি হয় না
এবং তারা তারা দুর্নীতি করতে সাহস পায়। আর জনগনও মনে করে "আচ্ছা, এটা তো সরকারের টাকাই। আমার টাকায় তো দুর্নীতি করছে না,
তাহলে এতো ক্যাচাল করে লাভ কী?"
এবার একটি নমুনা দেখা যাক:
এই স্ক্রিনশটটি ফেসবুকের "এড লাইব্রেরি" থেকে নেয়া, যেখানে তারা স্বচ্ছতা আনতে সব দেশে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন কারা দিচ্ছে, কী বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, এবং কত খরচ করছে তা দেখায়।
এখানে যে পেইজ গুলো দেখা যাচ্ছে সবগুলোই আওয়ামীলীগের বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা পেইজ। এই পেইজ গুলো থেকে তারা বিভিন্ন বিজ্ঞাপন চালায়। সরকার উন্নয়ন করছে,
বিএনপি-জামাত ষড়যন্ত্র লিপ্ত, স্বার্থান্বেসী মহল সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে, মূলত এসব দিয়ে বিভিন্ন ভিডিও ও ছবি তৈরি করে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়।
বিজ্ঞাপনে ২০২২ এর সেপ্টেম্বর থেকে জুলাই ২০২৪ (১ বছর ১০ মাস) পর্যন্ত কত খরচ করা হয়েছে তাও দেখানো হয়েছে।
এখানে লক্ষ করলে দেখা যাবে, জুনাইদ আহমেদ পলক প্রায় দুই বছরে খরচ করেছেন ২৬ হাজার ডলার বা প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা (ডলারের দাম গড়ে ১০০ টাকা ধরে)।
অর্থাৎ বছরে গড়ে ১৩ লক্ষ টাকা। অথচ নির্বাচনী হলফ নামা অনুসারে তার বছরে আয় ৩২ লক্ষ টাকা। তিনি কি এই আয়ের ১৩ লক্ষ টাকাই ফেসবুকে বিজ্ঞাপনে খরচ করেন?
উত্তর হচ্ছে: "অবশ্যই না"
তিনি আপনার বছরে দেয়া ১৪,২৩১ টাকা চাঁদা থেকে দুর্নীতি করেছেন এবং সেটা প্রোপাগান্ডা কাজে ব্যয় করছেন। কী, খারাপ লাগছে জেনে?
অনেক ব্যক্তি আছেন যারা প্রতিমাসে ১ লাখ - ২ লাখ টাকা আয় কর দিয়ে থাকেন।
অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা প্রতি মাসে ১০ লাখ - ১ কোটি বা তারো অধিক ভ্যাট দিয়ে থাকেন।
অন্যান্য দেশে
উন্নত দেশগুলোতে কখনোই "সরকারের টাকা" বলা হয় না, বরং বলা হয় "ট্যাক্সপেয়ার'স মানি" বা "করদাতাদের টাকায়"। এমনকি ঐদেশগুলো তে
যখন কোন উন্নয়ন কাজ করা হয়, তখন জনগন বিবেচনা করে দেখে কাজটি তাদের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায় করা ঠিক হচ্ছে কিনা। দুর্নীতি কিছুটা হলেও
সরকার এই টাকার স্বদ্যবহার করতে সবসময় সচেতন থাকে, কারন সবাই জানে এটা জনগনের টাকা এবং স্বদ্যবহার না করলে প্রচুর সমালোচনায় পড়তে হয় এবং
অনেক সময় পদত্যাগ করতে হয়। এরকম অনেক উদাহরণ আছে।
কিছু উদাহরণ
এই সেতু সম্পূর্ণ সরকারের টাকায় নির্মাণ করেছি।⎯⎯ হাসিনা, ৮ মে ২০২২
সায়ত্বশাসন আছে সত্যি, কিন্ত টাকা দিচ্ছে কারা? টাকা তো সরকার দিচ্ছে। সরকারের দেওয়া টাকা ইউজিসিতে যায়, সেখান থেকে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে সমস্ত শিক্ষকদের বেতন, ভাতা, সবকিছু তারা পাচ্ছেন। একজন শিক্ষার্থী ইউনিভার্সিটিতে কয় টাকা খরচ করে? মাসে বড়জোড় দেড়শ টাকা খরচ করে। এই টাকায় কি উচ্চশিক্ষা হয়? .... সে টাকা কে জোগান দেয়? টাকা জোগান দেয় সরকার। ... পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নাকি আমরা বুঝি না। .... অর্থ দেবে সরকার, সব রকম উন্নয়ন প্রকল্প সরকার করবে। সেটা নিতে খুব ভালো লাগবে আর সরকার সেখানে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না- এটা কখনও হতে পারে না। ... নিজেদের খরচ নিজেরা চালাবে। সরকার সব টাকা বন্ধ করে দেবে। কারন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, টাকা পাবলিক দেবে, সরকার কেন খরচ করবে?⎯⎯ হাসিনা, ৯ নভেম্বর ২০১৯
ঢাকার বস্তিবাসী যদি নিজ গ্রামে ফিরে যান তাহলে তাদের সরকারের টাকায় ঘর করে দেয়া, খাবারের ব্যবস্থা এবং টাকা-পয়সা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়⎯⎯ হাসিনা, ১ নভেম্বর ২০২o
সরকারের টাকায় বিদেশে মাস্টার্স, বয়স ৩৫ ও টোয়েফল–আইইএলটিএস থাকলে করুন আবেদন⎯⎯ প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০২৪
সলিমুল্লাহ হল যে তৈরি হল তা পুরোই সরকারের টাকায়⎯⎯ জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
সরকারের টাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১০ জন স্টাডি ট্যুরে যাবেন, এটা বন্ধ হবে⎯⎯ হাসিনা, ২৫ জুলাই ২০২২
সরকারের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে, শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পান।⎯⎯ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি, ০৮ মে ২০২১
আজকাল সরকারের টাকায় সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ আরো অনেকে হজে যাচ্ছেন৷ ইসলামের দৃষ্টিতে এটাকে কিভাবে দেখবেন?⎯⎯ হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলের সাংবাদিক, ২ আগস্ট ২০১৯
বিরোধী দলের অনেকে সরকারের টাকায় নির্বাচন করেছেন⎯⎯ অলি আহমেদ, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯